+88 01920-360-653

info@amarastha.com

অটিস্টিক শিশুদের মায়েরা তীব্র মানসিক চাপে

ছেলের ১৮ মাস বয়সে মা রোকশানা আক্তার জানতে পারেন, তাঁর সন্তান মোহাম্মদ মোহাইমেন স্বাভাবিক শিশু নয়। রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ঘোরাঘুরি করে জানতে পারলেন, ছেলে অটিস্টিক। এটি জানার পর স্বামী রোকশানাকে ছেড়ে চলে যান।

সাড়ে নয় বছরের মোহাইমেন বিএসএমএমইউর ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)–এর অটিস্টিক শিশুদের স্কুল পড়ে। রোকশানা পুরান ঢাকার বংশাল থেকে সপ্তাহে পাঁচ দিন ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যান। স্কুল শেষে ছেলেকে রিকশায় চড়িয়ে বাড়ি ফেরেন।

গত সপ্তাহে রোকশানার সঙ্গে কথা হয় ইপনাতে। শুধু স্বামী ছেড়ে গেছেন তা নয়, পরিবারের অন্যরাও তাদের ভালো চোখে দেখেন না বলে জানালেন রোকশানা। প্রতিবেশীরা তাঁর ছেলেকে এড়িয়ে চলে, অনেকে ঠাট্টা–তামাশা করে। এটা যে শুধু রোকশানার ক্ষেত্রে ঘটছে, তা নয়। একটি গবেষণা বলছে, এক–তৃতীয়াংশ অটিস্টিক শিশুর মায়েরা পরিবার ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে নেতিবাচক আচরণ পেয়ে থাকেন।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও সরকারের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি যৌথভাবে এই গবেষণা করেছে। গবেষণা বলছে, অটিস্টিক শিশুদের মায়েদের প্রায় অর্ধেক মানসিক রোগী। প্রধান গবেষক ও আইসিডিডিআরবির অসংক্রামক ব্যাধি শাখার বিজ্ঞানী আলিয়া নাহিদ বলেন, সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগলেও অনেক মা চিকিৎসকের কাছে যান না, যেতে পারেন না।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, অটিজম মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। এই সমস্যার কারণে শিশু অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। এরা একই কাজ বা আচরণ বারবার করে।

৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ৭ শতাংশ অটিস্টিক। মায়েদের ৪৫ শতাংশ বিষণ্নতায় আক্রান্ত।
এক-তৃতীয়াংশ অটিস্টিক শিশুর মায়েরা পরিবার-প্রতিবেশীর কাছ থেকে নেতিবাচক আচরণ পান।

এ মাসে প্রকাশিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৭ শতাংশ অটিস্টিক। অটিজম গ্রামের চেয়ে শহরে এবং মেয়েশিশুর চেয়ে ছেলেশিশুদের মধ্যে বেশি। গবেষকদের মতে, অটিজম বাড়ছে।

মূল্য দেয় মা

রাজধানী ঢাকায় অটিস্টিক শিশুদের জন্য প্রায় ১০০টি বিশেষ স্কুল আছে। ছয়টি বিশেষ স্কুলের ৩৮৮টি শিশুর মায়েদের নিয়ে আইসিডিডিআরবি এই গবেষণা করেছে। এই মায়েদের গড় বয়স ৩৯ বছর। ৭৭ শতাংশ মা ঘরে ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করেন না। ৫ শতাংশের স্বামী নেই, ১ শতাংশ বিধবা।

২০১৫ সালের মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জরিপের সময় শিশুদের গড় বয়স ছিল ১১ বছর ৭ মাস। ৭৯ শতাংশ শিশু ছিল ছেলে। ১৪ পৃষ্ঠার এই গবেষণা প্রবন্ধ গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অটিজম রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। গবেষণার প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এতে গ্রামের মায়েদের সমস্যা তুলে ধরা হয়নি।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৪১ শতাংশ মা একাই অটিস্টিক শিশুর দেখাশোনা করেন। ৫৯ শতাংশ মাকে সহায়তা করেন গৃহকর্মী, স্বামী, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, অন্য সন্তান এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবেশী।

এক–তৃতীয়াংশ মায়ের অভিযোগ, প্রতিবেশীরা অটিস্টিক শিশুদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। অনেকে পাগল বলে, তাচ্ছিল্ল করে। অনেকে আবার এসব শিশু দেখে ভয় পায়।

রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসিন্দা অপর্ণা দাশগুপ্তার ছেলে অনিন্দ দের বয়স ২১ বছর। চার বছর বয়সে অটিজম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে পরিবারের সদস্য, নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন সময় নানাভাবে হেনস্তা হয়েছেন তিনি। চোখে পানি আর মুখে হাসি নিয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ক্লাসে ছেলের পাশে বসে থাকতাম। অন্য শিশুদের আপত্তি ছিল না। বেশ কয়েক মাস চলার পর অন্য অভিভাবকদের আপত্তির কারণে আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্কুলের সিঁড়িতে বসে খুব কেঁদেছিলাম।’ সমাজ এখনো অটিস্টিক শিশুদের সমস্যা উপলব্ধি করার মতো সচেতন নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

মায়ের স্বাস্থ্যহানি

ইপনার পরিচালক অধ্যাপক শাহীন আখতার প্রথম আলোকে বলেন, শিশু অটিস্টিক হলে পরিবারের সবার ওপরই চাপ পড়ে, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন মা। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সমাজ মাকে দোষ দেয়। শিশুর লালনপালনের জন্য মা চাকরি ছেড়ে দেন। অনেকের সংসার ভেঙে যায়। শিশুকে আঁকড়ে থাকেন মা। এত চাপে মায়ের ঠিকমতো ঘুম হয় না, অধিকাংশের শরীর ভেঙে যায়। গবেষণায় এসব সত্যই উঠে এসেছে।

সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বিষণ্নতায় আক্রান্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, অটিস্টিক শিশুদের মায়েদের মধ্যে এই হার ৪৫ শতাংশ। ৬০ শতাংশ মা ডায়াবেটিসসহ একাধিক রোগে আক্রান্ত থাকার কথা বলেছেন।

ভয় মাকে ছাড়ে না

এসব মায়ের সামাজিক সহায়তা দরকার আছে বলে গবেষণার উপসংহারে বলা হয়েছে। এই সহায়তা হতে পারে বাড়িতে, হতে পারে সন্তানের স্কুলে। তবে মায়েদের জন্য এমন কোনো কর্মসূচি নেই।

অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, প্রাথমিক শিক্ষা, মহিলা ও শিশু এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জড়িত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক কর্মসূচি এ শিশুদের নিয়ে কাজ করে। কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণার পর এটা স্পষ্ট যে এসব মায়ের জন্য পৃথক সহায়তা দরকার।

রোকশানা বললেন, সহায়তা তাঁর খুবই দরকার। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর বংশালে মায়ের সংসারে এসে বুটিকের কাজ শুরু করেন তিনি। বলেন, ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেন না বলে কাজটিও তাঁর ঠিকমতো চলছে না। ছেলেকে ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে নিতে পারছেন না, শিক্ষক দিতে পারছেন না। বাসাভাড়া, প্রতিদিনের রিকশাভাড়া জোগাড় করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রোকশানা বললেন, ‘আমাদের মতো মায়েদের জন্য কোথাও কিছু নেই।’

Source: Prothom Alo

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *